ইউটিউবে কৌশল শেখে চট্টগ্রামের একদল ছিনতাইকারীর তাণ্ডব

নিউজ ডেস্ক :
ইউটিউবে সিনেমা দেখে নতুন কৌশল শেখে চট্টগ্রামের একদল ছিনতাইকারী; তারপর একটি প্রাইভেটকার ছিনতাই করে সেই গাড়ি নিয়ে টানা কয়েকদিন তারা কীভাবে তাণ্ডব চালিয়েছে, তার রোমহর্ষক বিবরণ উঠে এসেছে পুলিশের তদন্তে।

বুধবার রাতে চট্টগ্রামের বায়েজিদ থানার আরেফিন নগর ড্রাম গেইট থেকে ওই চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তারের কথা জানান পুলিশের উপ-কমিশনার (উত্তর) মোখলেসুর রহমান।
গ্রেপ্তার বেলাল হোসেন আসলাম (২৭), মো. তানভীর ইসলাম রোকন ওরফে রুকন (২৭), মো. সোহেল (৩০) ও কামাল উদ্দিন ওরফে মহিউদ্দিন (২৮) ‘পেশাদার ছিনতাইকারী’ বলে পুলিশের ভাষ্য।
উপ-কমিশনার মোখলেসুর রহমান বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ড যাওয়ার কথা বলে নগরীর অলঙ্কার মোড় থেকে একটি প্রাইভেট কার ভাড়া করে ওই যুবকের দল।
মাঝপথে তারা চালককে জিম্মি করে তার বাবার কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। এরপর মোবাইল ব্যাংকিং নম্বর ও পিন কোড নিয়ে চালককে রাস্তায় ফেলে গাড়ি নিয়ে চলে যায়।
সেই গাড়ি নিয়েই চক্রটি নগরীতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছিল এবং বিভিন্ন স্থানে ছিনতাই ও ডাকাতি করছিল বলে জানান উপ-কমিশনার মোখলেস।
“গ্রেপ্তার যুবকেরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে, বিদেশি সিনেমা দেখে প্রাইভেটকার ছিনতাইয়ের কৌশল রপ্ত করে তারা। সে অনুযায়ী ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা সাজায়,” বলেন তিনি।
প্রাইভেট কারের চালক মো. ইলিয়াছ বলেন, ৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় নগরীর বড়পুল থেকে গাড়িটি মেরামত করে সীতাকুণ্ডে বাড়ি ফিরছিলেন। এ সময় অলঙ্কার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকা তিন ব্যক্তি গাড়িটি থামার সংকেত দিয়ে সীতাকুণ্ডের দোয়াজি পাড়া এলাকায় যাওয়ার কথা বলে ৭০০ টাকায় ভাড়া করে।
“গাড়ি ভাড়া করার সময় তারা বলেছিল, বাঁশবাড়িয়া এলাকা থেকে তাদের পরিচিত এক আইনজীবীকে গাড়িতে তুলে নিতে হবে। বাঁশবাড়িয়া পৌঁছে তাদের পরিচিত সেই ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলতেই তারা আমাকে আমাকে মারধর করে পেছনের আসনে নিয়ে যায়। তাদের একজন চালকের আসনে বসে যায়।”
চালক বলেন, “গাড়ি নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার পর সীতাকুণ্ড উপজেলা সদর পর্যন্ত গিয়ে ইউটার্ন নিয়ে আবার নগরীর দিকে চলে আসে তারা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বায়েজিদ-ফৌজদারহাট লিংক রোডে আমাকে ফেলে দিয়ে বায়েজিদ থানার দিকে চলে যায় দ্রুত।
ছিনতাই হওয়া প্রাইভেট কারছিনতাই হওয়া প্রাইভেট কারইলিয়াছ তখন লিংক রোড এলাকায় গিয়ে পরিচিত এক দোকানে গিয়ে পুরো ঘটনা খুলে বলেন। সেই দোকানি তাকে নিয়ে যান ফৌজদার হাট পুলিশ বক্সে। বিস্তারিত ঘটনা শুনে পুলিশ তাকে মামলা করতে বলে।
তবে ছিনতাইকারী ওই যুবকের দল বসে থাকেনি। ছিনতাই করা গাড়ি নিয়েই নগরীর বিভিন্ন এলাকায় তারা কাজ চালিয়ে যায়।
সেদিনই রাত সাড়ে ৩টার দিকে নগরীর বায়েজিদ বোস্তামী থানার অক্সিজেন কাঁচা বাজার সংলগ্ন একটি ওষুধের দোকানে প্রাইভেট কার নিয়ে হানা দেয় একদল ডাকাত দল। সেখান থেকে ৭০ হাজার টাকা, মোবাইল ফোন ও একটি ট্যাব নিয়ে যায় তারা।
ওই ঘটনায় বায়েজীদ বোস্তামি থানায় করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পুলিশ সিসি ক্যামেরা দেখে নীল রঙের একটি প্রাইভেট কারের নম্বর সংগ্রহ করে। একই নম্বরের গাড়ি দিয়ে পরদিনও নগরীর অন্তত ১০টি স্থানে ছিনতাই করে ওই চক্র।
উপ-কমিশনার মোখলেস বলেন, “গাড়ির মালিককে খোঁজার এক পর্যায়ে পুলিশ জানতে পারে, সীতাকুণ্ড থানায় প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ের একটি মামলা হয়েছে। সেটি দিয়েই একটি চক্র ছিনতাই করছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়।”
মালিককে খুঁজতে ‘গলদঘর্ম’
ছিনতাই হওয়া প্রাইভেট কারের চালক মো. ইলিয়াছ বলেন, ওই গাড়ির মালিক সীতাকুণ্ডের মুরাদপুর এলাকার মো. শোয়ায়েব নামে এক ব্যক্তির, তিনি একজন সরকারি কর্মকর্তা। গত অক্টোবরে তিনি গাড়িটি কেনেন। তারপর থেকে ইলিয়াছ সেটি চালিয়ে আসছেন।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি মো. কামরুজ্জামান বলেন, “গাড়ির নম্বর শনাক্ত করে মালিকানা খুঁজতে গিয়ে পুলিশকে গলদঘর্ম হতে হয়। গাড়িটি ছয়জন মালিকের হাত ঘুরে এখন সপ্তম মালিকের কাছে।”
ওষুধের দোকানে ডাকাতির তদন্ত করতে গিয়ে সিসি ক্যামেরা দেখে নীল রঙের ওই গাড়ি চিহ্নিত করে বায়েজিদ বোস্তামীর পুলিশ। সেই নম্বর ধরে খোঁজ করতে গিয়ে তারা জানতে পারে, মালিক বর্তমানে সুইজারল্যন্ডে আছেন।
কিন্তু তার সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানান, কয়েক মাস আগে গাড়ি বিক্রি করে দেওয়া হয়েছে। পরের মালিকের ফোন নম্বরও তিনি পুলিশকে দেন, কিন্তু সেটা বন্ধ পাওয়া যায়।
বায়েজিদ বোস্তামীর ওসি বলেন, “এরপর সীতাকুণ্ডে গাড়ি ছিনতাইয়ের একটি মামলা হয়েছে খবর পেয়ে আমরা খোঁজ নিতে শুরু করি। দেখা গেল, ওই গাড়ির নম্বর আর নগরীতে ছিনতাইয়ের কাজে ব্যবহৃত গড়ির নম্বরের মিল আছে।”
গত অক্টোবরে গাড়িটি কিনলেও শোয়ায়েব মালিকানা পরিবর্তন না করায় এ বিপত্তি ঘটে বলে জানান ওসি।
‘পেশাদার ছিনতাইকারী’
গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে পুলিশ জানিয়েছে, মূলত আসলামের পরিকল্পনা অনুযায়ী তারা প্রাইভেট কারটি ছিনতাই করে ডাকাতি ও ছিনতাই শুরু করে। ছিনতাইয়ের এই কৌশল আসলাম বিদেশি একটি সিনেমা দেখে রপ্ত করে।
বায়েজিদ বোস্তামী থানার এসআই আজাহারুল ইসলাম বলেন, “আসলাম জানিয়েছে, সম্প্রতি ইউটিউবে আফ্রিকান একটি সিনেমায় গাড়ি ছিনতাই করে আপরাধ করার বিষয়টি দেখে সে। পরে অন্যদের নিয়ে প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা সাজায়।”
চক্রের সদস্যদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ জানতে পেরেছে, প্রাইভেট কার ছিনতাইয়ে সফল হয়ে ওই চক্রের সদস্যরা ফটিকছড়ির নাজিরহাটে মাইজভান্ডার শরীফে চলে যান জিয়ারত করতে। সেখানে গিয়ে তারা তাদের কাজের সফলতার জন্য মানতও করেন।
উপ-কমিশনার মোখলেস বলেন, “ফটিকছড়ির মাজার থেকে ফিরে অক্সিজেন কাঁচা বাজারে ওষুদের দোকানে ডাকাতি করে তারা। সেখান থেকে মুরাদপুর এলাকায় গিয়ে এক রিকশা আরোহীর কাছ থেকে মোবাইল ও নগদ টাকা ছিনিয়ে নেয়।”
গ্রেপ্তার চারজনের মধ্যে আসলামের বাড়ি নোয়াখালী সদরে। রুকনের বাড়ি সীতাকুণ্ডে হলেও থাকেন চট্টগ্রাম শহরের কর্নেলহাটে। সোহেল সীতাকুণ্ডে থাকেন, তার বাড়ি রাঙ্গুনিয়ায়। আর কামাল থাকেন সীতকুণ্ডের জঙ্গল ছলিমপুরে।
বায়েজিদ থানার ওসি বলেন, “এরা সবাই পেশাদার ছিনতাইকারী। রোকনের বিরুদ্ধে ছয়টা, সোহেলের বিরুদ্ধে চারটা এবং কামালের বিরুদ্ধে তিনটা মামলাও আছে। আসলামের নামে কোনো মামলা থাকার তথ্য এখনও আমরা পাইনি। তবে সেটা তার আসল নাম কিনা, সেটা খতিয়ে দেখতে হবে।”
গাড়ি রাখার ‘নিরাপদ স্থান’ হাসপাতাল
পুলিশ কর্মকর্তা মোখলেস বলেন, রাতে ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের পর দিনের আলো ফোটার আগেই চক্রের সদস্যরা প্রাইভেট কারটি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে রাস্তায় রেখে যে যার মতো চলে যান।
“পরদিন রোববার রাতে আবার সেখান থেকে মিলিত হয়ে রাতভর নগরীতে ঘুরে ঘুরে অন্তত ১০টি স্থানে ছিনতাই করে তারা। এভাবে ধরা পড়ার আগের দিন পর্যন্ত অনেকগুলো ঘটনা তারা ঘটিয়েছে।”
মূলত রাতে সড়কে গাড়ি কমে যাওয়ার পর এই চক্রটি সক্রিয় হত, ভোর পর্যন্ত ছিনতাই করে গাড়িটি চট্টগ্রাম মেডিকেলের সামনের সড়কে রেখে যেত।
সেখানে গাড়ি রাখার কারণ হিসাবে গ্রেপ্তাররা পুলিশকে বলেছেন, অনেক গাড়িই সেখানে ওভাবে থাকে। রোগীর গাড়ি মনে করে কেউ আটকাবে না ধরে নিয়েই তারা সেখানে পার্ক করতেন।
চক্রটিকে গ্রেপ্তারের পর একটি ওয়ান শুটার গান, চার রাউন্ড কার্তুজ ও ছুরি উদ্ধার করা হয়েছে। পরে তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি ট্যাব, ১০টি মোবাইল ফোন সেট ও ৪০ হাজার টাকাও জব্দ করার কথা জানিয়েছে পুলিশ। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
30 সর্বমোট পড়েছেন, 1 আজ পড়েছেন
